স্বাদের ওপর ভিত্তি করে কার্বোহাইড্রেট দু’প্রকার, যথা-
(১) শ্যুগার: এরা স্বাদে মিষ্টি, দানাদার এবং পানিতে দ্রবণীয়, যেমন- গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, সুকরোজ ইত্যাদি;
(২) নন-শ্যুগার: এরা স্বাদে মিষ্ট নয়, অদানাদার এবং পানিতে অদ্রবণীয়, যেমন- স্টার্চ, সেলুলোজ, গ্লাইকোজেন ইত্যাদি।
রাসায়নিক গঠন অণুর ভিত্তিতে কার্বোহাইড্রেটকে প্রধানত চার শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো-
১। মনোস্যাকারাইড;
২। ডাইস্যাকারাইড;
৩। অলিগোস্যাকারাইড এবং
৪। পলিস্যাকারাইড।
নিম্নে রাসায়নিক গঠন অনুযায়ী কার্বোহাইড্রেটের শ্রেণিবিভাগ বর্ণনা করা হলো।
১। মনোস্যাকারাইড:
যে কার্বোহাইড্রেটকে হাইড্রোলাইসিস করলে আর কোনো সরল কার্বোহাইড্রেট একক পাওয়া যায় না সেগুলোই মনোস্যাকারাইড। মনোস্যাকারাইড অন্যান্য জটিল কার্বেহাইড্রেট তৈরির গাঠনিক ইউনিট হিসেবে কাজ করে। এর সাধারণ সংকেত হচ্ছে: CnH2nOn। মনোস্যাকারাইডসমূহে একটি মুক্ত অ্যালডিহাইড গ্রুপ (-CHO) বা কিটোন গ্রুপ (-CO-) এবং একাধিক হাইড্রোক্সিল গ্রুপ (-OH) থাকে। মনোস্যাকারাইডে কার্বনের সংখ্যা ৩-১০। কার্বনের সংখ্যা অনুযায়ী মনোস্যাকারাইডকে তিন কার্বনবিশিষ্ট ট্রায়োজ, চার কার্বনবিশিষ্ট টেট্রোজ, পাঁচ কার্বনবিশিষ্ট পেন্টোজ, ছয় কার্বনবিশিষ্ট হেক্সোজ, সাত কার্বনবিশিষ্ট হেপ্টোজ ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হয়। জীবদেহের অধিকাংশ মনোস্যাকারাইড অপ্টিক্যাল আইসোমারের উ সিরিজভুক্ত।
মনোস্যাকারাইডগুলোতে অ্যালডিহাইড গ্রুপ (-CHO) বা কিটো গ্রুপ (>C=O) মুক্তভাবে থাকায় এরা বিজারক পদার্থ হিসেবে কাজ করে। কাজেই অ্যালডিহাইড বা কিটো গ্রুপযুক্ত কার্বোহাইড্রেটকে রিডিউসিং শ্যুগার বলা হয়। বেনেডিক্ট দ্রবণের Cu(OH)2 (কিউপ্রিক হাইড্রোক্সাইড) উক্ত শ্যুগারের -CHO বা >C=O গ্রুপের সাথে বিক্রিয়া করে কিউপ্রাস অক্সাইড (Cu2O)-এ পরিণত হয়, যা লাল বর্ণের অধঃক্ষেপ হিসেবে জমা হয়। রিডিউসিং শ্যুগার পরীক্ষা করতে তাই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। মনোস্যাকারাইডসমূহ সাধারণ মিষ্টি স্বাদবিশিষ্ট।
ট্রায়োজ:
তিন কার্বনবিশিষ্ট মনোস্যাকারাইডকে বলা হয় ট্রায়োজ। গ্লিসার্যালডিহাইড এবং ডাইহাইড্রোক্সি অ্যসিটোন হলো দুটি সরল ট্রায়োজ। এরা দ্রবণীয় মনোস্যাকারাইড। উদ্ভিদে এরা ফসফেট এস্টার হিসেবে কাজ করে। গ্লিসার্যাল্ডিহাইড-এর ১নং কার্বনে একটি কার্বনাইল অক্সিজেন যুক্ত হয়ে একে অ্যালডিহাইড গ্রুপ নির্দেশ করে এবং ডাইহাইড্রোক্সি অ্যাসিটোনের ২নং কার্বনে কার্বনাইল অক্সিজেন যুক্ত হয়ে একে কিটোন গ্রুপ নির্দেশ করে। কাজেই গ্লিসার্যাল্ডিহাইড হলো একটি অ্যালডোজ এবং ডাইহাইড্রোক্সি অ্যসিটোন হলো একটি কিটোজ। অ্যালডিহাইড এবং কিটোন গ্রুপকে বলা হয় রিডিউসিং গ্রুপ কারণ এরা সহজেই কতিপয় যৌগের সাথে জারিত হয়ে যায় এবং ঐ যৌগ বিজারিত হয়। তাই অ্যালডিহাইড ও কিটোন গ্রুপযুক্ত চিনিকে বলা হয় রিডিউসিং শ্যুগার বা বিজারক শর্করা।
টেট্রোজ:
চার কার্বনবিশিষ্ট মনোস্যাকারাইডকে বলা হয় টেট্রোজ। ইরিথ্রোজ হলো একটি টেট্রোজ। উদ্ভিদে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি ইরিথ্রোজ-৪ ফসফেট হিসেবে বিরাজ করে। ক্যালভিন চক্রে এর ভূমিকা আছে।
পেন্টোজ:
পাঁচ কার্বনবিশিষ্ট মনোস্যাকারাইডকে বলা হয় পেন্টোজ। জাইলোজ, রাইবোজ, ডিঅক্সিরাইবোজ, রাইবুলোজ ইত্যাদি হলো পেন্টোজ শ্যুগার-এর উদাহরণ।
রাইবোজ:
এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ কার্বনবিশিষ্ট পেন্টোজ শ্যুগার। ১৮৯১ সালে এমিল ফিসার এটি আবিস্কার করেন। এটি রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডের (RNA) একটি গঠন একক। এর আণবিক সংকেত: C5H10O5। এতে একটি এলডিহাইড গ্রুপ থাকায় এদের অ্যালডোপেন্টোজ বলা হয়। রাইবোজ শর্করার গলনাঙ্ক ৯৫ ডিগ্রি সে., গাঢ় হাইড্রোক্লোরিক এসিড এর সাথে বিক্রিয়া করে ফারফিউরাল অ্যাসিড উৎপন্ন করে। RNA -তে কেবলমাত্র রাইবোজ শ্যুগারই নিউক্লিয়োটাইড বা নিউক্লিয়োসাইড তৈরিতে অংশগ্রহণ করে। এটি নির্দিষ্ট পিউরিন বা পাইরিমিডিন বেস এর সাথে যুক্ত হয়ে একটি নিউক্লিয়োসাইড উৎপন্ন করে। নিউক্লিয়োসাইডের সাথে একটি অজৈব ফসফেট যুক্ত হয়ে নিউক্লিয়োটাইডে পরিণত হয়। কার্বন বিজারণের মাধ্যমে শর্করা তৈরি প্রক্রিয়াতেও রাইবোজ ভূমিকা পালন করে। ATP, NAD+, NADP+, FAD, Co-A ইত্যাদি জৈব অণুর সাথেও রাইবোজ যুক্ত থাকে।
ডিঅক্সিরাইবোজ:
ডিঅক্সিরাইবোজ আর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পেন্টোজ শ্যুগার। এর আণবিক সংকেত: C5H10O4। এতে একটি অ্যালডিহাইড গ্রুপ থাকায় একে ডিঅক্সিঅ্যালডোপেন্টোজও বলে। এটি রাইবোজ শ্যুগার-এর মতোই, পার্থক্য শুধু এই যে, এর ২নং কার্বনে হাইড্রক্সিল গ্রুপের পরিবর্তে কেবল একটি হাইড্রোজেন পরমাণু আছে। ডিঅক্সি অর্থ হলো অক্সিজেন ছাড়া অর্থাৎ ২নং কার্বনে কোনো অক্সিজেন নেই। এর ১নং কার্বন অবস্থানে যে কোনো একটি পিউরিন বা পাইরিমিডিন বেস (A,T,G,C) যুক্ত হলে একটি ডিঅক্সিনিউক্লিয়োসাইড সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় ৫নং কার্বন অবস্থানে অজৈব ফসফেট যুক্ত হলে একটি ডিঅক্সিনিউক্লিয়োটাইড সৃষ্টি হয়। DNA-নিউক্লিক অ্যাসিডের নিউক্লিয়োটাইড গঠনের অংশ হিসেবে বিরাজ করে ডিঅক্সিরাইবোজ শ্যুগার। এই শ্যুগার ছাড়া DNA গঠন সম্ভব নয়।
হেক্সোজ:
৬ কার্বনবিশিষ্ট মনোস্যাকারাইডকে বলা হয় হেক্সোজ। গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, ম্যানোজ, গ্যালাক্টোজ হলো প্রধান হেক্সোজ। এরা উদ্ভিদ কোষে মুক্ত অবস্থায় অথবা অন্য জটিল কার্বোহাইড্রেট-এর অংশ হিসেবে বিরাজ করে। সাধারণত গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজকে মুক্ত অবস্থায় সামান্য পরিমাণে পাওয়া যায়।
গ্লুকোজ:
গ্লুকোজ বা ডেক্সট্রোজ একটি উল্লেখযোগ্য মনোস্যাকারাইড। উদ্ভিদ কোষে দ্রবণীয় অবস্থায় একে পাওয়া যায়। এর আণবিক সংকেত: C6H12O6। এটি একটি অ্যালডোহেক্সোজ কারণ এতে অ্যালডিহাইড গ্রুপ আছে। এটি একটি রিডিউসিং শ্যুগার।
বিভিন্ন প্রকার পাকা ফল ও মধুতে প্রচুর গ্লুকোজ থাকে। পাকা আঙ্গুরে গ্লুকোজের পরিমাণ শতকরা ১২-৩০ ভাগ। একে অনেক সময় গ্রেইপ শ্যুগার বা আঙ্গুরের শর্করা বলা হয়। উদ্ভিদে গ্লুকোজ কখনো সঞ্চিত পদার্থ হিসেবে বিরাজ করে না। শ্বসনের প্রাথমিক পদার্থ হলো গ্লুকোজ।
উৎপাদন ও প্রস্তুত প্রণালি:
প্রকৃতিতে সবুজ উদ্ভিদ থেকে গ্লুকোজ উৎপাদিত হয়। আবার গবেষণাগারে হাইড্রোলাইসিস করে সুক্রোজ ও স্টার্চ থেকে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ প্রস্তুত করা যায়।
বৈশিষ্ট্য:
গ্লুকোজ সাদা দানাদার পদার্থ। স্বাদে মিষ্টি এবং পানিতে সহজেই দ্রবণীয়। এটি অ্যালকোহলে সামান্য দ্রবণীয় কিন্তু ইথারে অদ্রবণীয়।
গ্লুকোজের ব্যবহার:
রোগীর পথ্য হিসেবে গ্লুকোজ-এর বহুল ব্যবহার প্রচলিত। বিভিন্ন ফল সংরক্ষণে গ্লুকোজ ব্যবহার করা হয়। ক্যালসিয়াম গ্লুকোনেট হিসেবে ওষুধ শিল্পে গ্লুকোজ ব্যবহৃত হয়। ভিটামিন ‘সি’ তৈরি করার জন্য গ্লুকোজ ব্যবহৃত হয়। গ্লুকোজ কার্বোহাইড্রেট বিপাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গ্লুকোজের রিং স্ট্রাকচার এবং α/β-উ গ্লুকোজ:
গ্লুকোজের ১নং এবং ৫নং কার্বন কাছাকাছি এলে (দ্রবণে সাধারণত কাছাকাছি আসে) এদের মধ্যে একটি অক্সিজেন সেতু তৈরি হয়। এর ফলে ১নং কার্বনে একটি -OH গ্রুপ সৃষ্টি হয়। নতুন সৃষ্ট এই -OH গ্রুপ ১নং কার্বনের α (আলফা) বা β (বিটা) অবস্থানে থাকতে পারে। -OH গ্রুপের এই α এবং β অবস্থানের কারণে গ্লুকোজের ভৌত, রাসায়নিক এবং জৈবিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটে; যেমন- β-গ্লুকোজ গঠন করে সেলুলোজ, কিন্তু α -গ্লুকোজ গঠন করে স্টার্চ। সেলুলোজ কোষের গাঠনিক বস্তু এবং স্টার্চ কোষের সঞ্চয়ী খাদ্য বস্তু।
D এবং L গ্লুকোজ:
গ্লুকোজের ৫নং কার্বন হলো দূরবর্তী ‘অপ্রতিসম’ কার্বন। এই ৫নং কার্বনে সংযুক্ত -OH মূলক ডান দিকে থাকলে তাকে বলা হয় D-গ্লুকোজ। পাঁচ নং কার্বনে সংযুক্ত -OH মূলক বাম দিকে থাকলে তাকে বলা হয় L গ্লুকোজ। L এবং D শ্রেণির সমাণুগুলো পরস্পর দর্পণ প্রতিবিম্ব হয়। D-গ্লুকোজ দক্ষিণাবর্ত হয় যাকে d বা ‘+’ চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়। L-গ্লুকোজ বামাবর্ত হয় যাকে l বা ‘-’ চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়। দক্ষিণাবর্ত অর্থ হলো যৌগটি আলোক সক্রিয় এবং ঘূর্ণনের দিক ‘ডান’; বামাবর্ত অর্থ হলো যৌগটি আলোক সক্রিয় এবং ঘূর্ণনের দিক ‘বাম’। গ্লুকোজের ছোট ফ বা ছোট ষ র্ফম অপটিকাল রোটেশন ছাড়া অন্যান্য সকল ভৌত বৈশিষ্ট্য একই প্রকার। উদ্ভিদে সব সময়ই D-গ্লুকোজ থাকে।
ফ্রুক্টোজ:
গ্লুকোজের ন্যায় ফ্রুক্টোজও ৬ কার্বনবিশিষ্ট মনোস্যাকারাইড। এর আণবিক সংকেত গ্লুকোজের মতোই। এটিও একটি রিডিউসিং শ্যুগার। এর গঠনে রয়েছে একটি কিটো গ্রুপ। একে কিটোহেক্সোজও বলা হয়। অধিকাংশ পাকা মিষ্টি ফল ও মধুতে ফ্রুক্টোজ থাকে। তাই এর আরেক নাম ফলের চিনি বা ফ্রুট শ্যুগার। গ্লুকোজ থেকে সহজেই ফ্রুক্টোজ তৈরি হয় আবার সুক্রোজ হাইড্রোলাইসিস এর ফলেও ফ্রুক্টোজ তৈরি হয়। এটি সুক্রোজ এর একটি গঠন উপাদান। গ্লুকোজের মতো ফ্রুক্টোজও D এবং L দু’প্রকার আছে। প্রথম ফ্রুট তথা ফল থেকে শনাক্ত করা হয়েছিল বলে নাম করা হয় ফ্রুক্টোজ। ফ্রুক্টোজ সমপরিমাণ গ্লুকোজের সাথে যুক্ত হয়ে চিনি গঠন করে। তাই একে বীট ও আখের কান্ড রসে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
বৈশিষ্ট্য:
এটি একটি সাদা বর্ণের, দানাদার, স্ফটিকাকার ও মিষ্টি জাতীয় পদার্থ। পানিতে সহজেই দ্রবণীয়। গরম অ্যালকোহলেও দ্রবণীয়। গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজের আণবিক সংকেত এক হলেও এদের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। তাই এদেরকে আইসোমার বলে।
ব্যবহার:
কনফেকশনারিতে নানা ধরনের মিষ্টান্ন জাতীয় জিনিস প্রস্তুত করার জন্য ফ্রুক্টোজ ব্যবহার করা হয়। সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় প্রুক্টোজ তৈরি করে। সুক্রোজকে আর্দ্রবিশ্লেষণ করলে সমপরিমাণে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ তৈরি হয়।
ম্যানোজ: ম্যানোজ একটি হেক্সোজ। এর আণবিক সংকেত: C6H12O6। এটি একটি অ্যালডোজ শ্যুগার।
গ্যালাক্টোজ:
গ্যালাক্টোজ আর একটি হেক্সোজ। এর আণবিক সংকেত:C6H12O6। এটিও একটি অ্যালডোজ শ্যুগার।
গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, ম্যানোজ, গ্যালাক্টোজ হলো গাঠনিক আইসোমার। এদের সবার গাঠনিক ফর্মুলা C6H12O6 কিন্তু এদের এটমিক বিন্যাস ভিন্ন।
হেপ্টোজ: সাত কার্বনবিশিষ্ট মনোস্যাকারাইডকে বলা হকয় হেপ্টোজ। সেডোডেপ্টোলোজ হলো একটি হেপ্টোজ শ্যুগার।
(১) শ্যুগার: এরা স্বাদে মিষ্টি, দানাদার এবং পানিতে দ্রবণীয়, যেমন- গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, সুকরোজ ইত্যাদি;
(২) নন-শ্যুগার: এরা স্বাদে মিষ্ট নয়, অদানাদার এবং পানিতে অদ্রবণীয়, যেমন- স্টার্চ, সেলুলোজ, গ্লাইকোজেন ইত্যাদি।
রাসায়নিক গঠন অণুর ভিত্তিতে কার্বোহাইড্রেটকে প্রধানত চার শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো-
১। মনোস্যাকারাইড;
২। ডাইস্যাকারাইড;
৩। অলিগোস্যাকারাইড এবং
৪। পলিস্যাকারাইড।
নিম্নে রাসায়নিক গঠন অনুযায়ী কার্বোহাইড্রেটের শ্রেণিবিভাগ বর্ণনা করা হলো।
১। মনোস্যাকারাইড:
যে কার্বোহাইড্রেটকে হাইড্রোলাইসিস করলে আর কোনো সরল কার্বোহাইড্রেট একক পাওয়া যায় না সেগুলোই মনোস্যাকারাইড। মনোস্যাকারাইড অন্যান্য জটিল কার্বেহাইড্রেট তৈরির গাঠনিক ইউনিট হিসেবে কাজ করে। এর সাধারণ সংকেত হচ্ছে: CnH2nOn। মনোস্যাকারাইডসমূহে একটি মুক্ত অ্যালডিহাইড গ্রুপ (-CHO) বা কিটোন গ্রুপ (-CO-) এবং একাধিক হাইড্রোক্সিল গ্রুপ (-OH) থাকে। মনোস্যাকারাইডে কার্বনের সংখ্যা ৩-১০। কার্বনের সংখ্যা অনুযায়ী মনোস্যাকারাইডকে তিন কার্বনবিশিষ্ট ট্রায়োজ, চার কার্বনবিশিষ্ট টেট্রোজ, পাঁচ কার্বনবিশিষ্ট পেন্টোজ, ছয় কার্বনবিশিষ্ট হেক্সোজ, সাত কার্বনবিশিষ্ট হেপ্টোজ ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হয়। জীবদেহের অধিকাংশ মনোস্যাকারাইড অপ্টিক্যাল আইসোমারের উ সিরিজভুক্ত।
মনোস্যাকারাইডগুলোতে অ্যালডিহাইড গ্রুপ (-CHO) বা কিটো গ্রুপ (>C=O) মুক্তভাবে থাকায় এরা বিজারক পদার্থ হিসেবে কাজ করে। কাজেই অ্যালডিহাইড বা কিটো গ্রুপযুক্ত কার্বোহাইড্রেটকে রিডিউসিং শ্যুগার বলা হয়। বেনেডিক্ট দ্রবণের Cu(OH)2 (কিউপ্রিক হাইড্রোক্সাইড) উক্ত শ্যুগারের -CHO বা >C=O গ্রুপের সাথে বিক্রিয়া করে কিউপ্রাস অক্সাইড (Cu2O)-এ পরিণত হয়, যা লাল বর্ণের অধঃক্ষেপ হিসেবে জমা হয়। রিডিউসিং শ্যুগার পরীক্ষা করতে তাই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। মনোস্যাকারাইডসমূহ সাধারণ মিষ্টি স্বাদবিশিষ্ট।
ট্রায়োজ:
তিন কার্বনবিশিষ্ট মনোস্যাকারাইডকে বলা হয় ট্রায়োজ। গ্লিসার্যালডিহাইড এবং ডাইহাইড্রোক্সি অ্যসিটোন হলো দুটি সরল ট্রায়োজ। এরা দ্রবণীয় মনোস্যাকারাইড। উদ্ভিদে এরা ফসফেট এস্টার হিসেবে কাজ করে। গ্লিসার্যাল্ডিহাইড-এর ১নং কার্বনে একটি কার্বনাইল অক্সিজেন যুক্ত হয়ে একে অ্যালডিহাইড গ্রুপ নির্দেশ করে এবং ডাইহাইড্রোক্সি অ্যাসিটোনের ২নং কার্বনে কার্বনাইল অক্সিজেন যুক্ত হয়ে একে কিটোন গ্রুপ নির্দেশ করে। কাজেই গ্লিসার্যাল্ডিহাইড হলো একটি অ্যালডোজ এবং ডাইহাইড্রোক্সি অ্যসিটোন হলো একটি কিটোজ। অ্যালডিহাইড এবং কিটোন গ্রুপকে বলা হয় রিডিউসিং গ্রুপ কারণ এরা সহজেই কতিপয় যৌগের সাথে জারিত হয়ে যায় এবং ঐ যৌগ বিজারিত হয়। তাই অ্যালডিহাইড ও কিটোন গ্রুপযুক্ত চিনিকে বলা হয় রিডিউসিং শ্যুগার বা বিজারক শর্করা।
টেট্রোজ:
চার কার্বনবিশিষ্ট মনোস্যাকারাইডকে বলা হয় টেট্রোজ। ইরিথ্রোজ হলো একটি টেট্রোজ। উদ্ভিদে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি ইরিথ্রোজ-৪ ফসফেট হিসেবে বিরাজ করে। ক্যালভিন চক্রে এর ভূমিকা আছে।
পেন্টোজ:
পাঁচ কার্বনবিশিষ্ট মনোস্যাকারাইডকে বলা হয় পেন্টোজ। জাইলোজ, রাইবোজ, ডিঅক্সিরাইবোজ, রাইবুলোজ ইত্যাদি হলো পেন্টোজ শ্যুগার-এর উদাহরণ।
রাইবোজ:
এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ কার্বনবিশিষ্ট পেন্টোজ শ্যুগার। ১৮৯১ সালে এমিল ফিসার এটি আবিস্কার করেন। এটি রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডের (RNA) একটি গঠন একক। এর আণবিক সংকেত: C5H10O5। এতে একটি এলডিহাইড গ্রুপ থাকায় এদের অ্যালডোপেন্টোজ বলা হয়। রাইবোজ শর্করার গলনাঙ্ক ৯৫ ডিগ্রি সে., গাঢ় হাইড্রোক্লোরিক এসিড এর সাথে বিক্রিয়া করে ফারফিউরাল অ্যাসিড উৎপন্ন করে। RNA -তে কেবলমাত্র রাইবোজ শ্যুগারই নিউক্লিয়োটাইড বা নিউক্লিয়োসাইড তৈরিতে অংশগ্রহণ করে। এটি নির্দিষ্ট পিউরিন বা পাইরিমিডিন বেস এর সাথে যুক্ত হয়ে একটি নিউক্লিয়োসাইড উৎপন্ন করে। নিউক্লিয়োসাইডের সাথে একটি অজৈব ফসফেট যুক্ত হয়ে নিউক্লিয়োটাইডে পরিণত হয়। কার্বন বিজারণের মাধ্যমে শর্করা তৈরি প্রক্রিয়াতেও রাইবোজ ভূমিকা পালন করে। ATP, NAD+, NADP+, FAD, Co-A ইত্যাদি জৈব অণুর সাথেও রাইবোজ যুক্ত থাকে।
ডিঅক্সিরাইবোজ:
ডিঅক্সিরাইবোজ আর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পেন্টোজ শ্যুগার। এর আণবিক সংকেত: C5H10O4। এতে একটি অ্যালডিহাইড গ্রুপ থাকায় একে ডিঅক্সিঅ্যালডোপেন্টোজও বলে। এটি রাইবোজ শ্যুগার-এর মতোই, পার্থক্য শুধু এই যে, এর ২নং কার্বনে হাইড্রক্সিল গ্রুপের পরিবর্তে কেবল একটি হাইড্রোজেন পরমাণু আছে। ডিঅক্সি অর্থ হলো অক্সিজেন ছাড়া অর্থাৎ ২নং কার্বনে কোনো অক্সিজেন নেই। এর ১নং কার্বন অবস্থানে যে কোনো একটি পিউরিন বা পাইরিমিডিন বেস (A,T,G,C) যুক্ত হলে একটি ডিঅক্সিনিউক্লিয়োসাইড সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় ৫নং কার্বন অবস্থানে অজৈব ফসফেট যুক্ত হলে একটি ডিঅক্সিনিউক্লিয়োটাইড সৃষ্টি হয়। DNA-নিউক্লিক অ্যাসিডের নিউক্লিয়োটাইড গঠনের অংশ হিসেবে বিরাজ করে ডিঅক্সিরাইবোজ শ্যুগার। এই শ্যুগার ছাড়া DNA গঠন সম্ভব নয়।
হেক্সোজ:
৬ কার্বনবিশিষ্ট মনোস্যাকারাইডকে বলা হয় হেক্সোজ। গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, ম্যানোজ, গ্যালাক্টোজ হলো প্রধান হেক্সোজ। এরা উদ্ভিদ কোষে মুক্ত অবস্থায় অথবা অন্য জটিল কার্বোহাইড্রেট-এর অংশ হিসেবে বিরাজ করে। সাধারণত গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজকে মুক্ত অবস্থায় সামান্য পরিমাণে পাওয়া যায়।
গ্লুকোজ:
গ্লুকোজ বা ডেক্সট্রোজ একটি উল্লেখযোগ্য মনোস্যাকারাইড। উদ্ভিদ কোষে দ্রবণীয় অবস্থায় একে পাওয়া যায়। এর আণবিক সংকেত: C6H12O6। এটি একটি অ্যালডোহেক্সোজ কারণ এতে অ্যালডিহাইড গ্রুপ আছে। এটি একটি রিডিউসিং শ্যুগার।
বিভিন্ন প্রকার পাকা ফল ও মধুতে প্রচুর গ্লুকোজ থাকে। পাকা আঙ্গুরে গ্লুকোজের পরিমাণ শতকরা ১২-৩০ ভাগ। একে অনেক সময় গ্রেইপ শ্যুগার বা আঙ্গুরের শর্করা বলা হয়। উদ্ভিদে গ্লুকোজ কখনো সঞ্চিত পদার্থ হিসেবে বিরাজ করে না। শ্বসনের প্রাথমিক পদার্থ হলো গ্লুকোজ।
উৎপাদন ও প্রস্তুত প্রণালি:
প্রকৃতিতে সবুজ উদ্ভিদ থেকে গ্লুকোজ উৎপাদিত হয়। আবার গবেষণাগারে হাইড্রোলাইসিস করে সুক্রোজ ও স্টার্চ থেকে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ প্রস্তুত করা যায়।
বৈশিষ্ট্য:
গ্লুকোজ সাদা দানাদার পদার্থ। স্বাদে মিষ্টি এবং পানিতে সহজেই দ্রবণীয়। এটি অ্যালকোহলে সামান্য দ্রবণীয় কিন্তু ইথারে অদ্রবণীয়।
গ্লুকোজের ব্যবহার:
রোগীর পথ্য হিসেবে গ্লুকোজ-এর বহুল ব্যবহার প্রচলিত। বিভিন্ন ফল সংরক্ষণে গ্লুকোজ ব্যবহার করা হয়। ক্যালসিয়াম গ্লুকোনেট হিসেবে ওষুধ শিল্পে গ্লুকোজ ব্যবহৃত হয়। ভিটামিন ‘সি’ তৈরি করার জন্য গ্লুকোজ ব্যবহৃত হয়। গ্লুকোজ কার্বোহাইড্রেট বিপাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গ্লুকোজের রিং স্ট্রাকচার এবং α/β-উ গ্লুকোজ:
গ্লুকোজের ১নং এবং ৫নং কার্বন কাছাকাছি এলে (দ্রবণে সাধারণত কাছাকাছি আসে) এদের মধ্যে একটি অক্সিজেন সেতু তৈরি হয়। এর ফলে ১নং কার্বনে একটি -OH গ্রুপ সৃষ্টি হয়। নতুন সৃষ্ট এই -OH গ্রুপ ১নং কার্বনের α (আলফা) বা β (বিটা) অবস্থানে থাকতে পারে। -OH গ্রুপের এই α এবং β অবস্থানের কারণে গ্লুকোজের ভৌত, রাসায়নিক এবং জৈবিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটে; যেমন- β-গ্লুকোজ গঠন করে সেলুলোজ, কিন্তু α -গ্লুকোজ গঠন করে স্টার্চ। সেলুলোজ কোষের গাঠনিক বস্তু এবং স্টার্চ কোষের সঞ্চয়ী খাদ্য বস্তু।
D এবং L গ্লুকোজ:
গ্লুকোজের ৫নং কার্বন হলো দূরবর্তী ‘অপ্রতিসম’ কার্বন। এই ৫নং কার্বনে সংযুক্ত -OH মূলক ডান দিকে থাকলে তাকে বলা হয় D-গ্লুকোজ। পাঁচ নং কার্বনে সংযুক্ত -OH মূলক বাম দিকে থাকলে তাকে বলা হয় L গ্লুকোজ। L এবং D শ্রেণির সমাণুগুলো পরস্পর দর্পণ প্রতিবিম্ব হয়। D-গ্লুকোজ দক্ষিণাবর্ত হয় যাকে d বা ‘+’ চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়। L-গ্লুকোজ বামাবর্ত হয় যাকে l বা ‘-’ চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়। দক্ষিণাবর্ত অর্থ হলো যৌগটি আলোক সক্রিয় এবং ঘূর্ণনের দিক ‘ডান’; বামাবর্ত অর্থ হলো যৌগটি আলোক সক্রিয় এবং ঘূর্ণনের দিক ‘বাম’। গ্লুকোজের ছোট ফ বা ছোট ষ র্ফম অপটিকাল রোটেশন ছাড়া অন্যান্য সকল ভৌত বৈশিষ্ট্য একই প্রকার। উদ্ভিদে সব সময়ই D-গ্লুকোজ থাকে।
ফ্রুক্টোজ:
গ্লুকোজের ন্যায় ফ্রুক্টোজও ৬ কার্বনবিশিষ্ট মনোস্যাকারাইড। এর আণবিক সংকেত গ্লুকোজের মতোই। এটিও একটি রিডিউসিং শ্যুগার। এর গঠনে রয়েছে একটি কিটো গ্রুপ। একে কিটোহেক্সোজও বলা হয়। অধিকাংশ পাকা মিষ্টি ফল ও মধুতে ফ্রুক্টোজ থাকে। তাই এর আরেক নাম ফলের চিনি বা ফ্রুট শ্যুগার। গ্লুকোজ থেকে সহজেই ফ্রুক্টোজ তৈরি হয় আবার সুক্রোজ হাইড্রোলাইসিস এর ফলেও ফ্রুক্টোজ তৈরি হয়। এটি সুক্রোজ এর একটি গঠন উপাদান। গ্লুকোজের মতো ফ্রুক্টোজও D এবং L দু’প্রকার আছে। প্রথম ফ্রুট তথা ফল থেকে শনাক্ত করা হয়েছিল বলে নাম করা হয় ফ্রুক্টোজ। ফ্রুক্টোজ সমপরিমাণ গ্লুকোজের সাথে যুক্ত হয়ে চিনি গঠন করে। তাই একে বীট ও আখের কান্ড রসে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
বৈশিষ্ট্য:
এটি একটি সাদা বর্ণের, দানাদার, স্ফটিকাকার ও মিষ্টি জাতীয় পদার্থ। পানিতে সহজেই দ্রবণীয়। গরম অ্যালকোহলেও দ্রবণীয়। গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজের আণবিক সংকেত এক হলেও এদের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। তাই এদেরকে আইসোমার বলে।
ব্যবহার:
কনফেকশনারিতে নানা ধরনের মিষ্টান্ন জাতীয় জিনিস প্রস্তুত করার জন্য ফ্রুক্টোজ ব্যবহার করা হয়। সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় প্রুক্টোজ তৈরি করে। সুক্রোজকে আর্দ্রবিশ্লেষণ করলে সমপরিমাণে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ তৈরি হয়।
ম্যানোজ: ম্যানোজ একটি হেক্সোজ। এর আণবিক সংকেত: C6H12O6। এটি একটি অ্যালডোজ শ্যুগার।
গ্যালাক্টোজ:
গ্যালাক্টোজ আর একটি হেক্সোজ। এর আণবিক সংকেত:C6H12O6। এটিও একটি অ্যালডোজ শ্যুগার।
গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, ম্যানোজ, গ্যালাক্টোজ হলো গাঠনিক আইসোমার। এদের সবার গাঠনিক ফর্মুলা C6H12O6 কিন্তু এদের এটমিক বিন্যাস ভিন্ন।
হেপ্টোজ: সাত কার্বনবিশিষ্ট মনোস্যাকারাইডকে বলা হকয় হেপ্টোজ। সেডোডেপ্টোলোজ হলো একটি হেপ্টোজ শ্যুগার।
No comments:
Post a Comment